আমাদের দেশ
![]() |
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা |
ভূমিকাঃ- মা,মায়ের ভূমি আর মায়ের ভাষার প্রতি প্রেম আসল আসল চরিত্রের সুকুমার বৃত্তিগুলোর অন্যতম।“দশমাস দশদিন করে গর্ভধারণ,কষ্টের তিক্ততায় করেছেে লালন”।যে মা,যে দেশের আলো
বাতাসে আমাদের জীবন হয়েছে বিকশিত,আর যে ভাষায় বর্ণালি ছটায় আমরা প্রতিনিয়ত প্রকাশ করছি আমাদের মনের ভাব,সেই মা,
মাতৃভূমি আর মাতৃভাষার প্রতি আমাদের প্রেম-ভালোবাসা থাকাই স্বাভাবিক।তাই বহু ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যথার্থই বলেছেন,
“মাতা,মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা আমাদের কাছে সসর্বাপেক্ষা মূল্যবান।”
মা,মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি কীঃ- যার গর্ভে জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে আমাদের আগমন তিনিই মা।মা ছাড়া আমাদের অস্তিত্বই সম্ভব ছিল না।যে দেশে আমাদের জন্ম,যে দেশে বড় হওয়া,যে দেশে জীবন অতিবাহিত করা তা-ই মাতৃভূমি,প্রিয় স্বদেশ।আর যে ভাষার ব্যঞ্জনে মঞ্জুরিত হয় আমাদের প্রাত্যহিক মনোভাব,সেই তো মাতৃভাষা।
মা,মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রভাবঃ-মাতা,মাতৃভূমি আর মাতৃভাষার প্রভাব প্রতিটি মানব মনেই বিদ্যমান।অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো এগুলো আমাদের মমর্মমূলে থেকে কাজ করে যাচ্ছে।এদের প্রতি প্রেমই মানুষকে উদার করে,পরার্থে প্রাণ বিসর্জনে প্রেরণা দান করে।কবি তার কবিতায়,বিজ্ঞানী তার বিজ্ঞান সাধনায়,চিকিৎসক তার চিকিৎসায়,শিক্ষক তার শিক্ষাদানে এ দেশের প্রেমের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে সৃষ্টি করে ইতিহাস।তাই রবীন্দ্রনাথ লিখেন-
“আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।”
প্রেমের উৎসঃ- শিশুকে তার মা থেকে বিচ্ছিন্ন করলে,একজন বাঙালিকে অপরিচিত আফ্রিকায় নির্বাসিত করলে সৃষ্টি হবে এক বিসদৃশ পরিবেশের।কারণ,মা মাতৃভূমি মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা মাত্র।এরূপ ভালোবাসা শুধু সংসর্গজাত নয় জন্ম-জন্মান্তরের বংশানুক্রমিক ধারায়,বিশেষ রীতি-নীতি,শিক্ষা,সভ্যতার সমন্বয় থেকে এটি উদ্ভূত হয়।যার গর্ভে আমাদের জন্ম,যে দেশের আলো-বাতাসে লালিত পালিত,নিজের অজান্তেই সে মা আর মাতৃভূমির ভালোবাসা
আমাদের হৃদয়কে আকৃষ্ট করে।মাতৃভাষার মোহস্পর্শে সে ভালোবাসা আরো উদ্বেল হয়ে ওঠে।আর এ উদ্বেলিত ভালোবাসার নামই স্বদেশপ্রেম।মাতৃপ্রেমে আর স্বদেশপ্রীতিতে যার সমাপ্তি।
অভিব্যক্তিঃ- মাতা,মাতৃভাষা আর মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার সমন্বিত রূপ স্বদেশপ্রীতি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।কখনও তা থাকে সুপ্ত,কখনও বা জাগ্রত।ঐক্যবদ্ধভাবে যখন মানুষ একই প্রকার জীবন ধারায়,একই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারায় পুষ্ট হয়ে একই আদর্শের অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়,তখনই মৃন্ময়ী দেশ হয়ে ওঠে চিন্ময়ী।“ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে” দেশ তখন হয়ে ওঠে মাতৃভূমি।তখনি মনে হয় “জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপী গরীয়সী।” সুখের
দিনে এ প্রেম থাকে না।কিন্তু দেশ মাতৃকার দুর্দিনে,মাতৃভূমির স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে প্রিয় জানও কোরবান করতে মানুষ পিছনা হয় না।তাই মানুষ মাতৃভূমির প্রতিরূপ “একটি ফুলকে বাঁচাবে বলে যুদ্ধ করে”,“একটি ফুলের হাসির জন্য অস্ত্র ধরে”,অনাহার আর অনিদ্রাকে ভ্রুক্ষেপ না করে হাসিমুখে মৃত্যুপথে পতিত হয়।আর তখন মনে হয়---“নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান,ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।”
ধর্মীয় দৃষ্টিতেঃ- মহান ধর্ম ইসলামের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স) বলেন---স্বদেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।হিন্দু ধর্মে---“জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপী গরীয়সী” অঅর্থাৎ জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।আর তাই ঈমানের পরিপূর্ণতায়,স্বর্গাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষায় যুগে যুগে মানুষ প্রাণ দান করেছেন,আজও করছেন।বাংলাদেশের স্বাধীনতার তরেই শহীদ হয়েছেন প্রায় ত্রিশ লক্ষ লোক,
সম্ভ্রম হারিয়েছেন তিন লক্ষ মা-বোন।
দেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেমঃ- স্বদেশপ্রেম যখন সংকীর্ণতার অন্ধকূপে বন্দী হয়ে উগ্র ছিন্নমস্তকরূপ ধারণ করে,তখন বিশ্বপ্রেম পদদলিত হয়।কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে,উগ্র জাতীয়তাবাদ কেবল অকল্যাণ ডেকে আনে।সপক্ষে রবীন্দ্রনাথের অমিয় কাব্য গাথাঃ
“ও আমার দেশের মাটি,তোমার পরে ঠেকাই মাথা
তোমাতে বিশ্বময়ী বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।”
আমার দেশ,বিশ্বেরই একটি অভিন্ন অংশ।স্বদেশ ও বিশ্ব একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।তাই আমাদের উগ্র জাতীয়তাবাদ পরিহার করে চলতে হবে।
দেশপ্রেমিক যুগে যুগেঃ- জন্মদাত্রী মাকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে যার দেশপ্রেমের পথে যাত্রা শুরু সে তো শুধু মাতা ও মাতৃভূমিকেই ভালোবাসবে না।তার ভালোবাসার ব্যাপ্তি ঘটবে বিশ্বময়।বর্তমান বিশ্বসভ্যতা বিভিন্ন দেশপ্রেমিকেরই অবদান।সমাজ সংস্কার,
আবিষ্কার,বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা,সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্র
আত্মদানের মধ্য দিয়েই দেশপ্রেমিকেরা সৃষ্টি করেছেন আজকের এই দুনিয়া।ধর্মের বাণী মানুষকে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়েছে কিন্তু ধর্ম
প্রচারকগণ নিজেরা জীবন বিসর্জন দিয়ে ধর্মীয় সত্য প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।মূলত যারা দেশপ্রেমিক তাদের কাজ নিজের তরে নয়,দেশ ও
দশের তরে।
দেশপ্রেমের নামে নৈরাজ্যঃ- দেশপ্রেম হবে নিষ্কলুষ।কিন্তু অনেকে দেশপ্রেমের নামাবলি গায়ে জড়িয়ে সমাজে নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে।অনেক রাষ্ট্রনায়ক কায়েম করে একনায়কতন্ত্র।এরা দেশপ্রেমিক নয়,
এরা মাতৃভাষা আর মাতৃভূমির শত্রু।এদের কারণেই দেশ ধ্বংসের সম্মুখীন হয়।ইটালির মুসুলিনী,জার্মানির হিটলার এরা দেশপ্রেমের কলঙ্ক।এরা শুধু নিজের দেশেরই অশ্রু ঝরায় নি,বিশ্বমায়েরও অশ্রু ঝরিয়েছে।তাই ঘৃণার সাথে মানুষ তাদের স্মরণ করে।
উপসংহারঃ-আমাদের দেশ বাংলাদেশ।আমাদের প্রত্যেককে নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক হতে হবে।দেশ মাতৃকার কল্যাণে আমাদেরকে আন্তরিক হতে হবে।কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও যেন বলতে পারি---
“সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে,
সার্থক জনম মা গো তোমায় ভালোবেসে।”
Post a Comment